টাইফয়েড ও প্যারাটাইফয়েড জরে: Typhoid and Paratyphoid

 টাইফয়েড ও প্যারাটাইফয়েড জরে: Typhoid and Paratyphoid

ইতিহাস -অতি প্রাচীন কাল থেকে এই ধরণের রোগ বা আন্দ্রিক জ্বরের অস্তিত্ব ছিল। প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রেও আস্ত্রিক জ্বরের প্রমাণ পাওয়া যায়। যে সব দেশে পায়খানা, প্রস্রাব প্রভৃতির ব্যবস্থা বা Sanitation ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে সে সব দেশ থেকে এই রোগ বিদায় নিয়েছে। তবে সে সব দেশের ভ্রমণকারীরা বিদেশে গিয়ে এ রোগে আক্রান্ত হয়। এই রোগের কতকগুলি বিষয় বিশেষ প্রয়োজনীয় ও শিক্ষামূলক। এই রোগ প্রমাণ করে তাপের চার্ট রাখার প্রয়োজনীয়তা, লিউকোসাইট কাউন্ট করার প্রয়োজতীয়তাও এই রোগ থেকে বোঝা যায়। রক্ত কালচার করার মাধ্যমে নিশ্চিত ভাবে রোগ ধরা পড়ে। তাছাড়া আধুনিক স্যানিটেশন ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা ও মূল্য এই রোগ থেকে অনেকটা বুঝতে পারা যায়। উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশ গুলিতে এ রোগ যত প্রবল, উন্নত দেশগুলিতে তা নয়।

কারণ -

Salmonella typhi এবং Paratyphi নামে দুই বিভিন্ন জাতের বীজাণু থেকে এই দুটি রোগ হয়। কিন্তু তা সত্বেও রোগের লক্ষণ, প্রকাশ ও চিকিৎসা পদ্ধতি এক। তাই এই দুটি রোগ একত্রে বর্ণনা করা হচ্ছে।

রোদে ও তাপে এই রোগের বীজাণুর মৃত্যু হয়। কিন্তু ঠান্ডা জলে এরা জীবিত থাকে। এরা এক ধরণের ব্যাসিলাস জাতীয় বীজাণু।

Tropical এবং Subtropical দেশগুলিতে এই রোগ বেশি হয়। বিশেষ করে যে সব দেশের স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভাল নয়, মাঝে মাঝে এই রোগ Epidemic ভাবে সে দেশে ছড়ায়। তবে সাধারণতঃ এটি Enidemic ভাবেই থাকে। সাধারণত 10 থেকে 25 বছর বয়সে এটা বেশি হয় তবে সব বয়সেই হতে পারে।

মাছি, জল, খাদ্যদ্রব্য এবং মানুষের মাঝ দিয়ে এই রোগ ছড়ায় বেশি। নানারকম ভাবে রোগীর মল থেকে এ রোগ ছড়ায়। গ্রাম অঞ্চলে খাটা পায়খানা, মাঠে পায়খানা ইত্যাদির জন্য রোগ সহজে ছড়াতে পারে। সেখানে এই রোগ হতে থাকে, এবং ঠিকমতো স্বাস্থ্যবিধি পালন না করলে রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে।

এই রোগের ব্যাসিলিরা রোগ সেরে গেলেও, ব্লাডারে মাসের পর মাস বেঁচে থাকতে পারে এবং পায়খানার সঙ্গে বীজাণু, বের হতে থাকে।

প্রতিরোধ –


(1) রোগ শুরু হলে প্রতিষেধক T- A. B. ভ্যাকসিন দেওয়া অবশ্য কর্তব্য। অথবা খেতে হবে টাইফয়েডিনাম ২০০ এক মাত্রা।

(2) খাদ্যদ্রব্য ঢেকে রাখা উচিত-যাতে মাছি বসতে না পারে।

(3) কারও রোগ হলে রোগীর ব্যবহার্য বস্তুগুলিতে এবং মল-মূত্রে ভালভাবে বীজাণু নাশক ঔষধ দিয়ে দেওয়া উচিত-যাতে রোগ ছড়াতে না পারে।

দেহের ভিতরের পরিবর্তন (Morbid Anatomy)

আন্ত্রিক-এই বীজাণুর কাজ হলো ক্ষুদ্র অল্পে ক্ষত সৃষ্টি করা। কখনও কখনও বৃহৎ অন্ত্রেও ক্ষত সৃস্টি করে। Lymph গ্রন্থিতে রক্তাধিক্যে তা ফুলে যায়। এই অবস্থা পূর্ণ হয় 8-10 দিনের মধ্যে।

চিকিৎসা না হলে, সারা অন্ত্রে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘা হয়-সারা অন্ত্রে প্রদাহ হয়। তার ফলে কষ্ট হয় এবং রোগ দীর্ঘস্থায়ী ও কষ্টকর হয়।

চতুর্থ সপ্তাহে ক্ষতগুলি শুকাতে থাকে। যদি রোগী তাব মধ্যে না মরে, তা হলে ক্ষত কমতে থাকে এবং জ্বর কমার সঙ্গে সঙ্গে ঘাগুলি ক্রমশঃ শুকিয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে তা ভাল হয়ে যায়।

Mesenteric গ্রন্থিগুলি অস্ত্র থেকে বিষাক্ত পদার্থ বা Toxin নিয়ে ফুলে ওঠে। কখনও বা দু একটি গ্রন্থি পেকে ফেটে যায় এবং তার ফলে Peritonitis হয়ে থাকে।

পাকস্থলি ও অন্ননালী -এগুলির দু একটি জায়গায় ঘা হতে দেখা যায়।

প্লীহা- প্লীহাতে ক্তের আধিক্য হয় এবং তার ফলে প্লীহা বৃদ্ধি হয় এবং ফুলে ওঠে। Costal margin-এর নীচে প্লীহা অনুভব করা যায়, রোগ চলতে থাকলে এবং চিকিৎসা না হলে।

লিভার প্রভৃতি -লিভার, কিডনী ও হৃৎপিণ্ডে বিষাক্ত ঘা দেখা দেয়। পিত্ত কোষে (Gall bladder) প্রদাহ জনিত পরিবর্তন হয়ে থাকে।

কিডনী ও মূত্রাশয় প্রস্রাবের সঙ্গে সঙ্গে বীজাণুগুলি বেব হয়ে যেতে থাকে। কিন্তু পূজ হয় না বা Pus cells তাতে পাওয়া যায় না।

হাৎপিণ্ড-অনেক সময় হৃৎপিন্ডের মাংসে Granular degenaration দেখা যায়। বেশি দিন চললে Endocarditis হয়। যারা অনেকদিন রোগে ভোগে তাদের Arteriosclerosis দেখা যায়। মাঝে মাঝে Femoral vein বা প্রধান vein গুলিতে Thrombosis দেখা দেয়। অবশ্য খুব দীর্ঘদিন রোগে ভুগলে এমন লক্ষণ দেখা যায়।

শ্বাস-প্রশ্বাস যন্ত্র-যদি রোগের চিকিৎসা ঠিকমতো না হয়, তবে Larynx-এর

প্রদাহ দেখা দেয়। ফুসফুস ও ব্রঙ্কাস আক্রান্ত হয়ে Broncho নিউমোনিয়ার লক্ষণাদি দেখা দেয়। কিন্তু তাহলেও এটি প্রকৃত নিউমোনিয়া নয়। এতে টাইফয়েডের Secodary লক্ষণ থাকে না। এরূপ হতে থাকলে, রোগীর অবস্থা খারাপের দিকে যার।

রোগ লক্ষণসমূহ (Clinical signs and symptoms)

রোগের Incubation-এর সময় 7 থেকে 21 দিন। যার শরীয়ে ইমিউনিটি বেশি তার দেহে রোগ আক্রমণে বেশি সময় লাগে। অনেকের দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুব বেশি, হঠাৎ অন্য বীজাণুরা রোগ সৃষ্টি করতে পারে না। ইনকুবেশনের সময়ে বিশেষ কোন রোগ লক্ষণ থাকে না। তবে খুব ছোটদের ক্ষেত্রে পাতলা পায়খানা হয় ও প্রস্রাব কমে যায়।

তারপর রোগ শুরু হয়। চিকিৎসা ঠিকমতো না হলে রোগ পর পর যে ভাবে প্রকাশিত হয়, তাকে চারটি সপ্তাহে পৃথক পৃথকভাবে ভাগ করা হয়। প্রতি সপ্তাহে পৃথক পৃথক লক্ষণ দেখা দেয়। প্রথমে প্রতি সপ্তাহের সাধারণ রোগ লক্ষণ গুলি বর্ণনা করা হলো। পরে গুরুতর পরিণতি (Complications) কি কি হতে পারে, তা বর্ণনা করা হলো।



প্রথম সপ্তাহে প্রায়ই বোঝা যায় না। ধীরে ধীরে রোগ শুরু হয়। এ সময় প্রকৃত রোগ যে কি, তা সাধারণ বীজাণু থেকে জ্বর বা সর্দি' জ্বর হলে যে সব লক্ষণ দেখা দেয় সেই রকম বলে মনে হয়।

সাধারণ লক্ষণ হলো

1. দেহের মধ্যে একটা অবসাদ ভাব।

2. গা, হাত, পা, মাথা ব্যথা।

3. শীত শীত ভাব হয়, জ্বর বৃদ্ধি পায়।

4. জর রোজ ওঠা নামা করে। 99 ডিগ্রী থেকে 101 ডিগ্রী জ্বর ওঠা-নামা করতে থাকে। এই জ্বর ওঠা-নামা অনেক সময় রোগ নির্ণয় কে সন্দিহান করে তোলে। সকালের দিকে জ্বর নামে-ওঠে। তবে জ্বর ছাড়ে না। নামলে 98 ডিগ্রী পর্যন্ত নামে (বগলের তাপ) এবং জ্বরের চার্ট গ্রাফ করলে, তা একটা মইয়ের মতো (Ladder like) দেখা যায়।

5. মাঝে মাঝে বমিভাব বা বমি হতে পারে।

6. অক্ষুধা ও অগ্নিমান্দ্য দেখা দেয়। 5-7 দিন পর সব সময় পেট ভরা ভরা ভাব থাকে।

আবার অনেক সময় অন্য ভাবেও রোগ শুরু হতে পারে। হঠাৎ গায়ে কাঁপুনি, বুকে, পিঠে, মাথায় ব্যথা ও তাপ 101 থেকে 103 ডিগ্রী হতে দেখা যায়।

7. সপ্তাহের শেষ দিকে অর্থাৎ 5 থেকে 7 দিনের সময় জ্বরের বিশেষ লক্ষণ দেখা দেয়। জিহ্বা লেপাকৃত, জিবের Margin লাল হয়। বিখ্যাত Dr. Price-এর মতে-'Tongue with angry looks বলে মনে হয়।

৪. মুখাকৃতি অনুজ্জল, মুখের রং ফ্যাকাশে, গণ্ডস্থল লালচে (Malar flash) দেখা দেয়।

9. মাঝে মাঝে জজ্বর আসার সময় ঘাম হয়। ঘাম হয়ে জ্বর কমে, তবে ছাড়ে না।

10. অনেক সময় 6-7 দিনের মাথার চামড়াতে লালচে উচ্ছেদ (Erythematous rash) দেখা দেয়। অনেক সময় পেট ফাঁপে। প্লীহা সামান্য বৃদ্ধি হতে পারে। টাইফয়েডের Rash সাধারণতঃ 6 থেকে 20 দিনের মধ্যে যে কোন সময় বের হয়। মুখে প্রায়ই Rash থাকে না।

11. অনেক সময় জ্বরের সঙ্গে সঙ্গে সর্দি, কাশি, ব্রঙ্কাইটিস দেখা দিয়ে থাকে।

12. ঔষধ না পড়লে প্রতিদিন 3-4 বার পায়খানা হতে থাকে। অর্ধজলীর (Yellow brown) পায়খানা হয়।

13. প্রস্রাব অল্প পরিমাণে হয়, তবে তা গাঢ় ও লালচে রঙের হয়ে থাকে।

দ্বিতীয় সপ্তাহে -দ্বিতীয় সপ্তাহে লক্ষণগুলি প্রায়ই বেড়ে যায়। লক্ষণে কিছু কিছু পার্থক্য দেখা দেয়।

1. মাথা ব্যথা কমে বা থাকে না-দুর্বলতা খুব বেড়ে যায়।

2. শরীর শীর্ণ হতে থাকে ও দুর্বলতার জন্য চলাফেরা করতে খুব কষ্ট হয়।

3. ঠোঁট ফেটে যায়, জিহ্বা শুকনো হয়। ঠোঁটের কোণ ফেটে ঘা মত হতে পারে।

4. জিহ্বার উপরিভাগের সাদা আবরণ মাঝে মাঝে উঠে যায়।

5. পেট ফাঁপা বেড়ে যায়। অনেক সময় পেটে খুব ব্যথা অনুভব হতে থাকে।

6. পায়খানা সংখ্যায় বেড়ে যায়। রক্তমিশ্রিত হওয়াও সম্ভব।

7. জ্বর বেড়ে যায়। চিকিৎসা না হলে জ্বর নিচে 101 ও উপরে 103 ডিগ্রী মতো হয়।

৪. প্লীহার বৃদ্ধি বেশ স্পষ্ট বোঝা যায়।

9. এই সপ্তাহের শেষের দিকে রোগী প্রলাপ বকতে থাকে। কখনো বিড়বিড় করে প্রলাপ বকে-কখনো বা উচ্চকণ্ঠে রোগী প্রলাপ বকতে থাকে।

10. যদি ব্রকোনিউমোনিয়া এই সঙ্গে হয় তা হলে অবস্থা খুবই খারাপ হয়। তাহলে জ্বর 104 ডিগ্রী ওঠে এবং রোগী আচ্ছন্নের মতো পড়ে থাকে। রোগী প্রলাপ খুব বেশি বকে এবং রোগীর অবস্থা দেখে সকলে ভীত হয়।

তৃতীয় সপ্তাহে -এই সপ্তাহের প্রথম দিকে দ্বিতীয় সপ্তাহের লক্ষণগুলি চলতে থাকে ঠিক চিকিৎসা না হলে-

1. এই সপ্তাহের শেষের দিকে অবশ্য দেহের তাপ কিছু কমে এবং রোজ ওঠা-নামা ভাব ঠিক থাকে।

2. অনেক সময় সাংঘাতিক পরিণতির লক্ষণ সমূহ এই সপ্তাহে প্রকাশ পায়।

3. অতিরিক্ত রক্তস্রাব হতে থাকে পায়খানার সঙ্গে। অন্ত্রের প্রদাহ ও তার জন্য কষ্ট দেখা দেয়।

4. টাইফয়েডে মোহ (Coma) অবস্থা এই সপ্তাহের বৈশিষ্ট্য। সাংঘাতিক অবস্থার লক্ষণ এই সপ্তাহেই আসে। রোগী সংজ্ঞাহীন হতে পারে। নড়াচড়া করতে পারে না।

5. মাঝে মাঝে অবিরাম অসংলগ্ন প্রলাপ বকতে থাকে।

6. রোগীর হাত-পা ও জিহ্বাতে কম্পন দেখা দেয়। অনেক সময় রোগী বিছানা হাতড়াতে থাকে।

7. রোগী ক্রমে ক্ষীণ হয়ে পড়তে থাকে।

৪. পেট খুব বেশি ফোঁপে ওঠে ও কষ্ট হতে থাকে।

9. অনেক সমর Bedsore দেখা দিয়ে থাকে।

10. অনেক সময় এই সপ্তাহের শেষ দিকে বোগীর মৃত্যু ঘটে থাকে। যদি তা না হয়, তা হলে চতুর্থ সপ্তাহ থেকে রোগী আরোগ্যের দিকে যার।

চতুর্থ সপ্তাহে –

1. তৃতীয় সপ্তাহের সাংঘ তিক লক্ষণ প্রকাশ না পেলে ও রোগী বেচে গেলে, এই সপ্তাহে রোগ কমতে শুরু করে। তাপ কমতে কমতে 99- 100 তে আসে এবং তারপর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক তাপ ফিরে আসে। অনেক সময় তাপ 96 বা 98 ডিগ্রীতে নেমে এসে Collapse-এর দিকে যায়। এ বিষয়ে সাবধান থাকা কর্তব্য।

2. অনেক সময় এই সপ্তাহেও কিছু কিছু গুরুতর লক্ষণ প্রকাশ পায়। Femoral Thrombosis, অস্ত্রে ছিদ্র বা Perforation, Relapse প্রভৃতি এই সপ্তাহে হতে পারে। Relapse বা পুনুরাক্রমণ হলে তা খুব খারাপ, তা নির্ভর করে সুচিকিৎসক, নার্সিং প্রভৃতির ওপর। Relapse করলে আবার যথারীতি ভুগতে ভুগতে রোগী মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়।

গুরুতর পরিণতিসমূহ (Complications)

তৃতীয় সপ্তাহেই সাধারণতঃ বিভিন্ন গুরুতর লক্ষণ দেখা দেয়। অনেক সময় তা চতুর্থ সপ্তাহেও আত্মপ্রকাশ করে থাকে।

1. রক্তস্রাব-পায়খানার সঙ্গে প্রচুর রক্তস্রাব হতে থাকে। এর ফলে রোগী দুর্বল হয় ও মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। অন্ত্র থেকে এই সব রক্ত ক্ষরিত হয়।

2. রক্তস্রাব বেশি হতে থাকলে, হঠাৎ জ্বর কমে যায় ও দেহ ফ্যাকাশে দেখার, নাড়ির গতি দ্রুত হয়। অবসন্নতা, অস্থিরতা, পেটে খুব ব্যথা, পিপাসা প্রভৃতি দেখা দেয়। অনেক সময় পায়খানার সঙ্গে রক্তস্রাব লাল না হয়ে কালচে হয়।

3. অন্ত্রে ছিদ্র বা Perforation - ঠিক আধুনিক মতে চিকিৎসা না হলে

শতকরা 3-5টি রোগীর ক্ষেত্রে এই প্রবস্থা দেখা দিতে পারে। এই অবস্থার মৃত্যু ঘটা সম্ভব। পেটে তীব্র বেদনা হয়। কাঁপুনী ও Shock দেখা যায়। অনেক সময় Peritonitis-এর লক্ষণ দেখা দেয়।

4. অনেক সময় কানে শূনতে পার না। বধিরতা প্রকাশ পেয়ে থাকে। অনেক সময় খুব কম শুনতে পায়-দীর্ঘ দিন রোগে ভুগলে এই রকম হয়।

5. Colon-এ অনেক সময় আলসার হয় ও Colon-এ বড় বড় ঘা হতে পারে। অনেকবার পায়খানা হতে থাকে তার সঙ্গে রক্ত ও পূজ পড়তে থাকে।

6. Lobar নিউমোনিয়া-এটি হয় Secondary আক্রমণের জন্যে। এটি হলে তাপ খুব বেড়ে যায়। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত চলতে থাকে। রোগীর সঙ্কটাপন্ন অবস্থা হয়। নাড়ি ও শ্বাসের গতির Ratio ঠিক থাকে না।

7.

রক্তনালীতে গোলযোগ -সাধারণতঃ Femoral vein বা অন্যান্য শিরাতে রক্ত আটকে যায়। রক্তনালী Sclerosed হয়ে যায়।

৪. পিত্তকোষ প্রদাহ -Gall Bladder-এ প্রদাহ হলে এটি খুব খারাপ Complication-অনেক সময় এজন্য রোগী মারা যেতে পারে। অনেক সময় জন্ডিসের লক্ষণ দেখা দিয়ে থাকে।

9. Kidney ও প্রস্রাবের পথ-প্রস্রাবের পথ অনেক সময় আক্রান্ত হয়। প্রস্রাব খুব কম হতে থাকে। রোগী প্রস্রাবের জ্বালা অনুভব করতে পারে।

10. চর্মরোগী ভুগতে থাকলে প্রায়ই চর্মে শয্যাক্ষত বা Bedsore দেখা দেয়। Septicemia দেখা দেওয়াও অসম্ভর নয়। অনেক সময় ছোট ছোট ফোঁড়া দেখা দেয়।

11. স্নায়ুমণ্ডলী (Nervous system) - অনেক সময় টাইফয়েড রোগের তৃতীয় সপ্তাহে Cerebro Spinal জ্বরের মত বা মেনিনজাইটিসের মত Spinal Cord-এর লক্ষণ প্রকাশ পায়। এটি হয় কর্ডের ওপর Secondary আক্রমণের জন্য।

রোগ নির্ণয় (Diagnosis)

1. বিভিন্ন রোগ লক্ষণ রোগ নির্ণয় করতে সাহায্য করে।

2. জ্বরের রোজ ওঠা-নামা ও ক্রমে ক্রমে উপরে ওঠা বা বৃদ্ধি, তা সত্ত্বেও রোজ ওঠা-নামা বা মইয়ের মত চার্ট রোগ নির্ণয়ে সাহায্য করে।

3. জিহ্বন-জিহ্বা লেপাকৃত কিন্তু তার কিনারা লালচে-'Angry look' এটি রোগ নির্ণয়ে বিশেষভাবে শিক্ষা করলে, নিশ্চিতভাবে রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হয়।

4. রক্ত পরীক্ষা করলে রোগ ধরা যায়। এই পরীক্ষার নাম হলো Widal Test7 থেকে 10 দিনের মধ্যে রক্ত Culture করলে নিশ্চিত রোগ ধরা পড়ে।

5. রক্ত পরীক্ষার অন্যান্য ফল

(A) হিমোগ্লোবিন হ্রাস পেয়ে থাকে।

(B) রক্তের শ্বেত কণিকা কমে যায়। Poly কমে যায়।

(C) Lymphocyte বৃদ্ধি পায়।

চিকিৎসা

·       কোষ্ঠকাঠিন্য, অসহ্য মাথাব্যথা, মাথাঘোরা, বমি, মুখে তিক্ত আস্বাদ, লিভারে ব্যথা, জিহ্বা অপরিষ্কার, মুখে ব্যথা প্রভৃতি লক্ষণে, ব্রায়োনিয়া ৬।

·       বিকার মৃদু গতিতে প্রকাশ পেতে থাকলে-ব্রায়োনিয়া ৬, ৩০। উদরাময় থাকলে এটি চলবে না।

·       যদি উগ্রভাবে রোগের বিকাশ হয় সঙ্গে সঙ্গে রাসটক্স ৬ প্রয়োগ করতে হবে।

·       চোখের পাতা ভার, তন্দ্রাভাব, চোখ বুজে থাকতে ভাল লাগে, পা-হাত ভাঙে বা ব্যথা ভাব, মাথাব্যথা যন্ত্রণা, দৌর্বল্য, হাত-পা, জিহ্বা প্রভৃতির কম্পন লক্ষণে, জেলসিমিয়াম ১৪-৩ দিতে হবে।

·       রোগের সূচনা থেকে সব অবস্থাতেই উপকারী ঔষধ টাইফয়েডিনাম ৩০ বা ২০০।

·       স্থূল, কোমল অথচ দ্রুত নাড়ি, প্রলাপ, মাথায় ব্যথা, গায়ে ব্যথা, ঠোঁট ও জিহ্বা শুকনো, অস্থিরতা, অচৈতন্য ভাব, শয্যাকণ্টক, গলার মধ্যে ক্ষত, দুর্গন্ধ শ্বাস প্রশ্নস, বমি, বমনেচ্ছাভাব (রোগের প্রথম অবস্থায়), শ্লেটের মত বর্ণে'র মল (রোগ আক্রমণের দ্বিতীয় সপ্তাহে এমন হতে পারে)-রোগী মনে করে তার দেহ দু-তিন খণ্ডে বিভক্ত -এই সব লক্ষণে, শ্রেষ্ঠ ঔষধ হলো ব্যাটিসিয়া ১৪-৩।

·       যদি ব্যাপটিসিয়াতে ঠিক মতো কাজ পাওয়া না যায়, তাহলে দিতে হবে, পাইরোজেন ৩০।

·       পেট ফাঁপা, পেটে চাপ দিলে ব্যথা বোথ, অবসন্নভাব, মাঝে মাঝে আমযুক্ত জলের মত পাতলা পায়খানা, অসাড়ে দুর্গন্ধ মল, চিবুক কাঁপে, স্মৃতিলোপ, দিনের বেলায় তন্দ্রার মত ভাব, শীত এবং উত্তাপসহ জর, এক পাশে ঘাম, বিড়বিড় করে বকা বা ডিলিরিয়াম, নাক থেকে রক্তস্রাব (কখনো কখনো), জিহ্বা সাদা লেপাকৃত-কেবল অগ্রভাগ লাল, অস্থিরতা, হাত-পা ও ধব নাড়া, এপাশ ওপাশ করলে রোগের উপশম লক্ষণে রাস্টক্স ৬, ৩০ বিশেষ উপকারী।

·       দেহ নাড়াচাড়া করতে না পারলে বা নড়াচড়া ভাল লাগে না, এই সব লক্ষণে এবং গা জ্বালা বা পেট জ্বালা থাকলে, আর্সেনিক ৬ ব্য ৩০ উপকারী।

·       সর্বাঙ্গে ব্যথা বোধ, শয্যা কঠিন অনুভব, অচৈতন্য অবস্থা, বা প্রলাপ, নিশ্বাসে দুর্গন্ধ, গায়ে ফুস্কুড়ি উজ্জম প্রভৃতি হলে, আর্ণিকা মণ্ট ৩৪-৬ উপকারী।

·       সর্বাঙ্গে জ্বালা, অবসন্ন ভাব, শীতল ঘাম, অতৃপ্ত পিপাসা, উদরাময় প্রভৃতি লক্ষণে, আর্সেনিক ৬, ৩০।

·       হাত-পা ঠান্ডা, বিশেষ করে পা ঠান্ডা, নাড়ি লোপ, শীতল ঘাম, দুর্গন্ধ ভেদ, জীবনী শক্তির হ্রাস প্রভৃতি লক্ষণে, কার্বোভেজ ৩, , ৩০ উপকারী।

·       প্রবল মাথা ধরা, চোখ, মুখ লাল, চমকে চমকে ওঠা, প্রলাপ, লাফাতে বা কামড়াতে যাওয়া প্রভৃতি লক্ষণে, বেলেডোনা ৬, ৩০।

·       বেলেডোনার চেয়ে লক্ষণ আরও প্রচণ্ডতর হলে, স্ট্যামোনিয়াম ৩,৬।

·       বেলেডোনার লক্ষ্মণের থেকে মৃদু লক্ষণে দিতে হবে, হায়োসায়ামাস্ ৩৪।

·       উদরাময় গাঁজলা গাঁজলা সবুজ বা কাল ভেদ, নিশ্বাসে দুর্গন্ধ, মুখ বা গলার মধ্যে ক্ষত প্রভৃতি লক্ষণ থাকলে, মার্কসল ৬, ৩০। কোষ্ঠকাঠিন্য, পেট ফাঁপা, অচৈতন্য, দুর্বলতা লক্ষণে দিতে হবে, লাইকোপোডিয়াম ৩০।

·       রোগ উপশমের সময় যদি অস্ত্রে ক্ষত থাকে এবং তার জন্য বারবার উদরাময় হতে থাকে, তাহালে টেরিবিহু ৬ দিতে হবে।

·       মোহ (Coma) বা আচ্ছন্নভাৰ থাকলে বেলেডোনা ৬, ওপিয়াম ৩০ অথবা নাক্স মস্কেটা ২৪ দিলে উপকার হয়।

·       টাইফয়েডের সঙ্গে নিউমোনিয়ার লক্ষণ থাকলে দিতে হবে, ফসফরাস ৬, ওপিয়াম ৩০, অ্যান্টিম টার্ট ৬ অথবা লাইকোপোডিয়াম ১২।

·       প্রতিষেধক ব্যবস্থ। -

 এই রোগের শ্রেষ্ঠ প্রতিষেধক ঔষধ হলো টাইফয়েডিনাম ৩০ বা ২০০। বাড়ির কারো এই রোগ হলে অন্য সকলকে এটি এক মাত্রা খাওয়ানো উচিত।

এই রোগে অবশ্য পালনীয় নিয়ম

1. এই রোগে রোগীকে সম্পূর্ণভাবে বিছানায় শুইয়ে রাখা কর্তব্য। শায়িত অবস্থায় পথ্যাদি গ্রহণ, মলমূত্র ত্যাগ করাতে হবে। বেশি নড়াচড়া বা ওঠানামা নিষেধ।

2. আলো-বাতাসযুক্ত পৃথক ঘরে রোগীকে রাখা কর্তব্য।

3. রোগীর মলমূত্র পৃথক স্থানে ফেলতে হবে। সেগুলি মাটিতে পুতে ফেলা উচিত। সব সময় বীজাণুনাশক ঔষধ, যেমন-ব্লিচিং পাউডার, লাইজল, ডেটল প্রভৃতি ব্যবহার করতে হবে। কোন ভাবেই যেন সংক্রমণ না হয়।

4. বাড়ির সকলকে T. A. B. ভ্যাকসিন বা T. A. B. C. ভ্যাকসিন দেওয়া কর্তব্য অথবা হোমিওপ্যাথিক শ্রেষ্ঠ প্রতিষেধক ঔষধ টাইফয়েডিনাম ৩০ বা ২০০ এক মাত্রা খেতে দিতে হবে।

5. সব রকম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে নজর রাখা কর্তব্য।

6. সব সময় ভালভাবে সেবাশুশ্রুষা করা একান্ত প্রয়োজন। এদিকে বিশেষ নজর রাখা কর্তব্য।

7. আবশ্যক মত মাঝে মাঝে রোগীকে গরম জলে গা মুছিয়ে দিতে হবে। স্পঞ্জিং করতে হবে। জ্বর বেশি উঠলে ঠান্ডা জল দিয়ে মাথা ধোয়াতে হবে বা মাথায় Ice bag প্রয়োগ করতে হবে।

৪. যাতে শয্যাক্ষত (Bedsore) না হয় সেদিক ভালভাবে নজর রাখতে হবে। রোগীর পিঠে ট্যালকম পাউডার নিয়মিত দিতে হবে। রবার ক্লথ বিছানার উপর পেতে দেওয়া খুব ভাল। পিঠের ও কোমরের উঁচু হাড়ের ত্বকে ভাল করে স্পিরিট দিয়ে তার উপর পাউডার দিতে হবে।

9. রোগীর বালিশ, তোষক, শয্যা, কাপড়-চোপড় রোজ বদলে দিতে হবে এবং রোজ জিনিসপত্র রোদে দিতে হবে।

10. কঠিন ও গুরুপাক খাদ্য হানিকর। প্রচুর পুষ্টিকর, লঘুপাচ্য খাদ্য দিতে হবে। সেই খাদ্য হলো-ছানা, মাখন-তোলা দুধ, মিষ্টি দুই বা ঘোল, হরলিক্স হাইড্রোপ্রোটিন বা প্রোটিনেক্স, প্রভৃতি। জ্বর ছেড়ে গেলে সব চালের ভাত ও ছোট মাছের হালকা ঝোল উপকারী।

11. যদি প্রথম দিকে কোষ্ঠকাঠিন্য হয় তা হলে পারগেটিভ দেওয়া উচিত নয়। তার বদলে দিতে হবে Glycerine সাপোজিটারী বা Enema প্রভৃতি।

12. রোগীকে সব সময় শান্তিতে ও প্রফুল্ল মনে রাখার চেষ্টা করতে হবে।

                                            ডা: এস এস পান্ডের “প্র্যাকটিস অব মেডিসিন” বই থেকে হুবহু সংকলিত।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url